ঘুম শহরের বাসিন্দা
- সাগর আল হেলাল
সামান্য জানালা খোলা। শীতকাল এখনো ঘরে ফেরেনি। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে শরীরটাকে আদর করার জন্য। নৈশ কোচে সময় বাঁচে আবার নিরাপত্তা সুরক্ষাও হয়। সন্ধ্যায় অচেনা শহরে প্রবেশ করে যে কোন ভ্রমনকারী অথবা ব্যবসায়ী বিপদে পড়তেই পারেন ! বাংলাদেশ এগোয়নি অতোদূর এখনো, যেখানে মানুষেরা নিরাপদ। শেষ রাতের জোছনা ম্রিয়মান আলো ছড়াচ্ছে। ঘুম ঢুলছে চোখের পাতায়। গন্তব্যে পৌঁছতে সকাল সাতটা বেজে যাবে। নো টেনশন। চোখের পাতা দুটোকে তালা দেওয়ার চেষ্টা করি ঘুম আটকানোর জন্য। নাহ্ ! ব্যর্থ। নতুন পরিবেশের সুগন্ধ মগজের ভেতর জেগে হৈচৈ করে। দেখে নাও, জুড়িয়ে নাও চোখ প্রকৃতি অবলোকনে।
দৌলতদিয়া ঘাট অনেক আগে পাড় করেছি। আমার আকাঙ্ক্ষিত শহরের সীমানায় প্রবেশ করলো নৈশ কোচ। মনটা চনমন করছে। অনেক দিনে ইচ্ছে, এই এলাকা ভ্রমনের। রাত্র পোহাতেই পূরণ হবে আমার মনোবাসনা। ক্যামেরা এনেছি, সাথে ল্যাপটপও আছে। ছবি তুলে সাথে সাথে ফেসবুকে সবার সাথে শেয়ার করবো এটাই ইচ্ছে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমাদের বাস গন্তব্যে পৌঁছালো। শহর ঘুমিয়ে আছে। বাসের সুপারভাইজার ঘোষণা দিলো- গেট লাগিয়ে দিচ্ছি। আপনারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন। দিনের আলো ফুটলে আমরা ডেকে দিবো। আমার ঘুম আসছে না। এবার চোখ দুটো শক্ত হাতে বন্ধ করলাম।
সূর্যের আলো মুখে পড়ায় লাফিয়ে খুলে গেলো চোখের দরজা। সবাই ঘুমুচ্ছে। আমার দেরী সইলো না। বাস থেকে নামার জন্য ঘুমন্ত সুপারভাইজারের সাহায্য নিতে হলো। শহর জাগে নি। হাঁটতে আরম্ভ করলাম। একটা ছোট্ট চা দোকান খুলেছে। পানি ফুটছে কেটলিতে। দোকানী মনে হলো আধা ঘুমে। তাকে বললাম-
- চা খাওয়ানো যাবে ?
- হ’ যাইবো। বসেন, আপনিই প্রথম কাস্টমার। বিস্কুট দেবো ?
- ভালো হলে দাও।
দোকান থেকে বের হয়ে চারিদিক ভালো মতো দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। ক্যামেরার ঢাকনা খুলে ফেলেছি। কারো বাসা-বাড়িতে যাবো না। সারাদিন এলাকাটা ঘুরবো, তারপর রাতের কোচে ঢাকা। কিন্তু এখানের মানুষ জনের যেন ঘুমই ভাঙছে না। আটটা বেজে গেছে। কারণ কি ! এমন সুনসান ভুতুড়ে অবস্থায় পড়িনি আগে কখনো। বিষয়টি শেয়ার করার মতো কাউকে পাচ্ছিও না। হাঁটছি সামনের দিকে। দু’ একটা ছবিও তুলেছি এরই মধ্যে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ রাস্তার পাশে নজরে এলো এক অন্ধ ভিক্ষুক। সে কি জানে এ সবের কারণ। আমি তার সামনে গিয়ে বসলাম। শব্দ শুনে সে বুঝে ফেললো আমি বসে পড়েছি। ফিসফিস করে বললো-
- ফেব্রুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ থেকে ঘুমাচ্ছে ওরা। অ’গো সাথে আরো অনেকেই ঘুমাচ্ছে। ওরা ঘুম শহরের বাসিন্দা।
- মানে ?
- বাংলাদেশ আর আম্রিকার মইধ্যে তারে তারে যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধ না থামা পর্যন্ত এ’গো ঘুম ভাঙবো না।
- তুমি বুঝলা ক্যামনে ?
- আমি চক্ষে দেহিনা, তাই বুঝি। এই দ্যাশের বেবাক মানুষ যেইদিন পুরাই আন্ধা হইবো, সেই দিন সবাই সব বুঝবো।
ওর কথা মনে হয় সামান্য বুঝতে পেরেছি। আমি শহরের দিকে ইউটার্ন করি। আমার ইচ্ছেরা লজ্জা পেয়েছে। আজকেই ঢাকা ফিরতে হবে আমাকে। বড্ডো ঘুম পাচ্ছে !
-
৪.৪.২০২২
No comments